শাহ মেরিন রিসোর্ট, বকচর, জামির্তা, সিঙ্গাইর, মানিকগঞ্জ।



নগর জীবনে যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন মনটা ছুটে যেতে চায় প্রকৃতির কাছে। কিন্তু ছকে বাধা সময়ের বেড়াজালে প্রকৃতি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ একদমই পাওয়া যায় না। তবে নগর বাসিন্দাদের এমন হাঁসফাঁস জীবনকে খানিকটা সময়ের জন্য সবুজ করে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে শাহ মেরিন রিসোর্ট। ঢাকার সীমানা পেরুলেই দেখা মিলবে রিসোর্টটির। সাভার হেমায়েতপুরের পেরিয়ে সিংগাইরে পা রাখলেই চোখে পড়বে সবুজ, সুন্দর একটি গ্রাম। গ্রামের গহীনে, যে জায়গাটা একেবারে নিরিবিলি- নির্জন, সেখানেই মূলত এ রিসোর্টটি। একপাশে ধলেশ্বরী অন্য পাশে সবুজ গ্রাম। নগর থেকে ছাড়া পেয়ে এমন কিছুর দেখা পেয়েই তো মনটা আনন্দে মেতে ওঠে।

৪ বিঘা জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে শাহ মেরিন রিসোর্ট। একটি পূর্ণাঙ্গ জাহাজের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে রিসোর্টের মূল ভবন। যেখানে ঢুকলে মনে হবে, জাহাজটি আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উত্তাল ঢেউ তোলা সাগরে। রিসোর্টের একপাশে ধলেশ্বরীর জল আছড়ে পড়ে। কান পাতলে শোনা যাবে জলের কলকল শব্দ।

সম্প্রতি তৈরি করা এ রিসোর্টে সুইমিং পুলও আছে। সারাদিন- সারারাতের যখন খুশি তখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন নীল জলে। সাঁতার কেটে ছাড়িয়ে নিতে শরীরের যতো আড়মোড়া। আর যদি চান নদীতে ঘুরে বেড়াতে সে সুযোগও আছে। স্পিডবোট কিংবা ট্রলারে করে ধলেশ্বরী ঘুরিয়ে আনার ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। নির্দিষ্ট ভাড়া পরিশোধ করেই ঘুরে আসতে পারেন নদীতে।

অতিথিদের জন্য নানা আয়োজনে সাজানো থাকে এ রিসোর্ট। তার মধ্যে রাতের খাবারে বারবি কিউ একটি। নদীর পাড়ে রাতের এ বারবি কিউ পার্টির কথা একবার চিন্তা করুন তো? কয়লায় পুড়ে নেয়া গরম গরম চিকেন প্লেটে তুলে যখন মুখে পুরবেন, তখন হয়তো গা ছুঁয়ে যাবে ধলেশ্বরী থেকে ভেসে আসা শান্ত বাতাস।

শাহ মেরিন রিসোর্টটি মানুষের অবসর কাটানোর প্রিয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা। তাদের মতে, এটি হবে রাজধানীর সবচেয়ে কাছের আকর্ষণীয় ও উন্নত অবকাশ কেন্দ্র।

এটার আদলেই বানানো হচ্ছে রিসোর্টের ভবনটি, Source: ভূমি প্রকাশ



জাহাজের নকশায় তৈরি বিশ্বের প্রথম রিসোর্ট কোরিয়ান সানক্রুজ। শাহ মেরিন রিসোর্টের মূল ভবনটি জাহাজের আদলেই তৈরি করা হয়েছে। হয়েছে না বলে হচ্ছে বলাটাই ভালো। কারণ রিসোর্টটি এখনো নির্মাণাধীন। সাত তলা রিসোর্টের তিন তলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। একটা জাহাজের আদলে তৈরি করা রিসোর্ট, সৃজনশীলতা আছে বলতেই হবে!
উঠোনের একধারে নদীর পাশে বসার জায়গা আছে, Source: ভূমি প্রকাশ



তিন একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা রিসোর্টের এই জায়গাটিতে প্রথমে মেরিন অ্যান্ড বিজনেস ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাস ছিল। কোনো কারণে ক্যাম্পাসটি এখান থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ধলেশ্বরী নদীর পাড়, Source: ভূমি প্রকাশ



রিসোর্টের ইন্টেরিয়র ডিজাইনেও তারা জাহাজের অভ্যন্তরীণ ছবির সঙ্গে মিল রাখার চেষ্টা করেছে। রিসোর্টের ভেতরে ঢুকে মনে হচ্ছিল লাক্সারি কোনো এক ক্রুজ শিপে ভ্রমণ করছি! দেয়ালে দেয়ালে জাহাজীদের ঘড়ি টাঙানো। ডেকের আদল আনতে রুমগুলোতে জানালার বদলে গ্লাসের আবরণ দেওয়া হয়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত আর ধলেশ্বরীর সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছিল।
বিকেলে যখন ঝড় উঠেছিল, তখন নদীর উত্তাল পানির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, সত্যিই বিস্তৃত জলধিতে একটা জাহাজের মধ্যে রয়েছি। কেবল জাহাজের দুলুনিটাই মস করছিলাম।
রিসোর্টের সামনের প্লেগ্রাউন্ডে খেলাধুলায় মত্ত, Source: ভূমি প্রকাশ



রিসোর্টের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটি সম্ভবত সুইমিং পুল। প্লে-গ্রাউন্ডে লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট খেলে লেখকবৃন্দ পুলে যে নেমেছেন, ওঠার আর নাম গন্ধ নেই। তাই মেয়েরা পুলে নামার সুযোগ পেয়েছে রাতে। অন্ধকার নামার সাথে সাথে পুলের পানিতে জ্বলে উঠেছে লাল-নীল-সবুজ রঙের বাতি। পানির রঙ বদলে দেওয়া ওই ঠান্ডা আলোতে ভেসে থাকার অনুভূতি অন্যরকম।
আলোকোজ্জ্বল রাতের সুইমিংপুল, Source: ভূমি প্রকাশ



বিকেলে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হওয়ায় ছেলেরা সবাই আউটডোর খেলা বাদ দিয়ে ইনডোরে এসে উঠলো। ইনডোরে খেলার মতো অনেক উপকরণ ছিল রিসোর্টে। টেবিল টেনিস, কেরম, লুডু। একটা জিমনেশিয়ামও আছে।
নদীর দিকে মুখ করে দেওয়া নান্দনিক দোলনা, Source: ভূমি প্রকাশ



বাস্কেট বল খেলার গ্রাউন্ডের পাশেই ধলেশ্বরীর ধার ঘেঁষে নদীর দিকে মুখ করে একটা কাঠের দোলনা ঝোলানো আছে। শুধু দোলনা না বলে দোলনাঘর বলা যায়। একটা ছাউনি আছে দোলনার উপরে। নদীর পাড়ে এমন একটা দোলনায় দুলতে যে কেউ খুব পছন্দ করবে।
সুইমিংপুল, Source: ভূমি প্রকাশ



দিন শেষে ক্লান্ত পায়ে সবুজ ঘাসে হাঁটার জায়গা এখন তেমন কোথাও নেই বললেই চলে। কিন্তু সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে রিসোর্টে। ধলেশ্বরীকে পেছনে রেখে প্লেগ্রাউন্ডকে পেছনে ফেলে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে একটা পিচঢালা পথ। রাস্তাটার দুই পাশে গাঢ় সবুজ ঘাস। সেই সাথে বিভিন্ন অচেনা ফুলের বেড। বেগুনী-হলুদ-কমলা রঙের ফুল ফুটে আছে ওতে। দেখলেই যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানেও একটা ফোয়ারা বানানো হয়েছে। তবে ওটার আকৃতির রহস্যটা উদঘাটন করতে পারিনি। আসলে এই রাস্তাটাই মূল প্রবেশপথ। রাস্তার কাজ চলছে, তাই নদীপথে এসেছি আমরা।
মনোরোম পানির ফোয়ারা, রাতে আলোকছটায় রঙিন হয়ে যায় এর জলরাশি, Source: ভূমি প্রকাশ



রাতের বেলা সুইমিংপুলের মতো পুরো রিসোর্টেই মনোরম আলোর ঝলকানি দেখা যায়। পুল, রেলিং, দোলনা, ফোয়ারা; সবকিছুর মধ্যেই রঙিন বাতি লাগানো আছে। অন্ধকার হলেই সব জ্বলে ওঠে।
রিসোর্টের খাবারের মান বেশ ভালো। পাঁচ বেলা খাবার খেয়েছি আমরা। প্রত্যেক বেলার খাবারই বেশ মানসম্মত আর সুস্বাদু ছিল।
আরোও একটা ফোয়ারা। এর আকৃতির রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি, Source: ভূমি প্রকাশ



তবে একটা সমস্যা আছে। নদীর পাড় হওয়ায় প্রচুর বাতাস থাকে ওখানে। বাতাসে সমস্যা নেই, সমস্যা হলো বাতাসে ভেসে আসা গন্ধে! ধলেশ্বরীর ঠিক ওপারেই ট্যানারি শিল্প। ট্যানারির বর্জ্য ধলেশ্বরীতে ফেলা হয়, ফলে নদীর পানি আর বাতাস – দুটোই দূষিত হয়ে পড়েছে। সেই দুর্গন্ধময় বাতাস নাকে ঝাপটা দিলে মুখ কুঁচকে ফেলতেই হয়। আচ্ছা, আমাদের শিল্পকারখানাগুলোর বর্জ্য কি নদী ছাড়া আর কোথাও ফেলার জায়গা নেই?
রাস্তাজুড়ে কৃত্তিম পদ্মপাতা, Source: ভূমি প্রকাশ



মূলত ট্যানারি শিল্পের উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে শাহ মেরিন রিসোর্ট। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে বিদেশি ক্রেতারা এসে কোথায় থাকবেন তা নিয়ে বরাবরই চিন্তিত ছিলেন ট্যানারি মালিকরা। সেই চিন্তা দূর করতে চামড়া শিল্পনগরী থেকে নদী পথে তিন মিনিটের দূরত্বে তৈরি হয়েছে এই রিসোর্ট। বিদেশি ক্রেতাদের থাকার উপযোগী করে তৈরি হয়েছে রিসোর্টটির সবগুলো কক্ষ। আধুনিক সব সুবিধার মাধ্যমেই সাজানো হয়েছে ৫০টি রুম, তৈরি হচ্ছে আরও ১০০টি।
রাস্তার দুইধারে মনোরম ফুলের বেড, Source: ভূমি প্রকাশ


খরচ: এখানে থাকতে প্রতিদিন সিঙ্গেল রুমের জন্য খরচ পড়বে আড়াই হাজার টাকা আর ডাবল রুমে থাকতে গুণতে হবে ৫ হাজার টাকা। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজ এবং মেম্বারশিপের সুবিধা।
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে হেমায়েতপুর, ওখান থেকে ট্যানারির ২ নম্বর রোডের পানির ট্যাংকে আসতে হবে ইজিবাইকে করে।
ট্যানারির ক্রেতা ও উদ্যোক্তাদের সাথে সাথে বুকিং দেওয়া অতিথিদের জন্য এখানকার ঘাটে সার্বক্ষণিক নৌকার ব্যবস্থা আছে। নৌকায় করে ৩ মিনিটে পৌঁছে যাবেন চায়না ঘাটে অবস্থিত শাহ মেরিন রিসোর্টে, যা সম্পূর্ণ ফ্রি। কেউ যদি সড়ক পথে রিসোর্টে আসতে চান তারা চামড়া শিল্পনগরী থেকে রিসোর্টের ০১৯৬৬৫৯৪০১১ নম্বরে ফোন করলেই রিসোর্টের নিজস্ব গাড়ি পৌঁছে যাবে তাকে আনতে। এ সুবিধা ট্যানারির ক্রেতা ও উদ্যোক্তাদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি। অন্যান্য অতিথিদের ক্ষেত্রে গাড়ির সুবিধাটা আলোচনা সাপেক্ষে। আমরা দুটো হায়েস ভাড়া করে গিয়েছিলাম।
অথবা গাবতলী থেকে হেমায়েতপুর হয়ে সিঙ্গাইর ব্রিজ। ওখান থেকে হাতের বামের রাস্তা ধরে এলেই শাহ মেরিন রিসোর্ট।
তথ্যসূত্রঃ https://tripzone.xyz/shah-marine-resort/ এবং নেটের বিভিন্ন অংশ থেকে সংগৃহীত । 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

সহিদুলের লেখা