ভাগ্যলিপি


ভাগ্যলিপি
.............. 
মোহাম্মদ সহিদুল ইসলাম

আসসালাতু খাইরুম নিনান নাওম, মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠের আহব্বানে অর্ধঘুম ভাঙ্গে কল্পনার। কয়েকদিন হলো চোখে ঘুম নেই, একটু চোখ বুজলেই নবাগত'র কান্নায় ঘুম থেকে আতকে ওঠে কল্পনা। কিশোরী কল্পনা মা হবার কথা নয়। তবু আজ সে মা হয়েছে। প্রথম মা হবার অনুভূতি, বলে বুঝানো দায়।

এই তো সেদিনের কথা। যখন বাবুর জন্ম হল, সেই সাথে যেন নতুন করে জন্ম হলো কল্পনার। খুব ভয় করেছিল সেদিন। মৃত্যু ভয়। শুরু হলো মা হবার যন্ত্রণা, এ যেন মৃত্যু অনুভূতি! যেন মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে হঠাৎ ময়না পাখির চিৎকার শুনে এক আজব অনুভূতি হলো। অভিমান, আনন্দ আর ছেলেকে দেখার মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় নিমিষেই হারিয়ে গেল অসম্ভব যন্ত্রণা। কল্পনা আল্লাহকে হাজার শুকরিয়া জানালো পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত দান করার জন্য।

"নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা’আলারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন।
অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।" - সূরা আশ-শুরা, অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে কল্পনা চিরন্তন এই বাণী গুলি নিয়মিত শোনেন। শুধুমাত্র সন্তানকে সুস্থভাবে জন্ম দেবার জন্য মায়ের কত আশা-আকাংখা, কত ত্যাগ-তিতিক্ষা। নিত্যদিনের সিকনেস, শরীরের তথইবচ অবস্থা, খাবারে গন্ধ অরুচি বমি হওয়া আবার বিশেষ কিছু খাবার জন্য ক্রেজিনেস এই সবই সন্তানকে পেটে নিয়ে প্রতিটা মায়ের মত কল্পনারও এযে সুখ দুঃখের গল্প।

সকল কষ্ট ভুলে কিশোরী মায়ের মুখে হাসি। আজ বাবুর ৭ দিন, নাম রাখা হবে। সারারাত ঘুম হয়নি। হঠাৎ দরজাতে ঠকঠক আওয়াজ।
কল্পনা-কে..?
ভাগ্য-লিপিকর - আমি ভাগ্য লিপিকর,
ভাগ্য-লিপিকর - দরজা খুলে দিয়ে, আসুন,
ভাগ্য-লিপিকর - ভাগ্য লিপিতে রত,
কল্পনা-কি লিখলেন আমার পুত্রের ভাগ্যে?
ভাগ্য-লিপিকর - না, বলা যাবে না,
কল্পনা-কেন বলা যাবে না?
ভাগ্য-লিপিকর - না, না বলা যাবে না,
কল্পনা-না, আপনাকে বলতেই হবে,
ভাগ্য-লিপিকর - বল্লে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে।
কল্পনা-আল্লাহ কি এমন ভাগ্য দিয়েছে? যে বলা যাবে না,
ভাগ্য-লিপিকর - হ্যাঁ এমনি কঠিন যে তা বলা যাবে না,
কল্পনা-পা জড়িয়ে ধরছি, বলুন, না হলে পা ছাড়বো না।
ভাগ্য-লিপিকর - আচ্ছা বলছি শোন, তোর কোলে যে সন্তান, এর সাথে তোর বিয়ে হবে।

এ কথা শুনে কল্পনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এ কি করে সম্ভব খোদা! ভাবতে ভাবতে কল্পনা সিদ্ধান্ত নিলো হয় নিজে মরবো না হয় এই সন্তানকে মেরে ফেলবো, তবু এমন হতে আমি দেবো না। এ কথা ভেবেই বটিদা হাতে নিলো কল্পনা। শরীর কেঁপে উঠলো। নাড়ি ছেড়া ধন, পুত্রের মাথায় সজোরে একটি কোপ মেরে আর পেছনে না তাকিয়ে সোজা দৌড়াতে লাগলো। দায়ের কোপে হত্যা করা ছেলের মুখ বার বার চোখে ভেসে উঠছে আর বেহুশে দৌড়াচ্ছে। বেহুশে দৌড়াতে দৌড়াতে অচেনা এলাকায় এক এক বড় কৃষক পরিবারে আশ্রয় চাইলো কল্পনা। বাড়ির মালিক বল্লেন, কেন, তোমার কি কেউ নেই? কল্পনা জবাব দিলো পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। বাড়িওয়ালা মনে মনে চিন্তা করলো আমার তো কাজের জন্য লোক লাগেই, চিন্তা করে বল্লো, আচ্ছা তোমাকে আশ্রয় দেবো তবে আমার সংসারের কাজ করতে হবে। কল্পনা রাজি হলো, এই পরিবারে বাস করতে লাগলো।

এদিকে, কপালে বটির কোপে আহত ছেলেটির চিৎকারে আশেপাশের লোকজন চলে এলো। আহত, মৃতপ্রায় ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হলো। কিন্তু কেউ তাকে নিতে এলো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিভাবক না পেয়ে, এক ধনীর হাতে তুলে দিল। তাদেরও সন্তান ছিল, তবু মানবিকতার দৃষ্টিকোন থেকে ছেলেটিকে লালন-পালনের দায়িত্ব নিলো। আস্তে আস্তে ছেলে বড় হলো। এখন সে প্রাপ্তবয়স্ক। বাড়িওয়ালা ছেলের বিয়ে ঠিক করলো।

আজ ছেলেটির বিয়ে, সমস্ত আয়োজন শেষ, বিয়ে করে বউ ঘরে আনলো। রাত ১২টা, বাসররাতে বাসরে ঢুকে ছালাম দিল আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ১২ টার দিকে তার স্বামী ঘরে ঢুকল, ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। স্বামী ঘরে ঢুকলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলো। পায়ে হাত দেওয়ার আগেই স্বামী তার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো।

এমন মোটা শাড়ি পরে আর কতক্ষন থাকবে? এইটা খুলে অন্য শাড়ি পরো। এই বলে অন্য রুম থেকে একটা সুতি শাড়ি এনে দিল। বউকে শাড়িটা চেঞ্জ করতে বলে স্বামী রুম থেকে বের হয়ে গেল...

এরপর যখন রুমে আসলো তখন কিছু খাবার নিয়ে আসলো আর বল্লো আজ রাতে শুধুই তুমি তোমার জীবনের গল্প শোনাবে, আর আমি আমার জীবনের গল্প শোনাবো।

অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো দুজনের। স্ত্রীর অনেক কথা শোনা হলো। স্ত্রী বল্লো তুমি তো জানোই আমার ছোট বয়সে এক বিয়ে হয়েছিল। একটা ছেলেরও মা হয়েছিলাম আমি, এটাও তো জানো। নিয়তির নির্মম পরিহাসে সেই ছেলেকে নিজ আমি হাতে হত্যা করেছি। এবার স্বামী বলছে তার জীবন কাহিনী। সেই শুরু থেকে, যেখান থেকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে। কেমন সেই মৃত্যুর দুয়ার? স্ত্রীর প্রশ্ন।
শুনবে?
হ্যাঁ অবশ্যই,
তবে শোন,
আমার মা আমাকে বটির আঘাতে রক্তাক্ত করে পালিয়ে যায়। লোকজন আমাকে উদ্ধার করে। আমি সুস্থ হই। আমার কেউ না থাকায় আমার এই বর্তমান পরিবার আমার লালন-পালন করে। এখন পরিবারের গৃহকর্তা এবং গৃহকর্ত্রী আমার বাবা মা।
তুমি কি বলছ? আতকে উঠে স্ত্রী বলছে।
স্বামী- হ্যাঁ আমি ঠিক বলেছি। এই দেখো আমার কপালে বটির কাটা দাগ আছে।
এবার স্ত্রী ভালভাবে দেখে হ্যাঁ কপালে বটির কাটা দাগ আছে। আরো শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেখলো বুকের ডান পাশে একটি বড় তিল আছে নাকি। হ্যাঁ বুকের ডান পাশে বড় একটি তিল আছে।

এবার সে নিশ্চিত, এ যে তারই ছেলে। হাউমাউ করে করে কেঁদে উঠলো। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, বল্লো তুই যে আমারই সন্তান। আমিই তোকে মারতে চেয়েছিলাম। সকল ঘটনা জেনে নিশ্চিত হলো তারা আসলেই সম্পর্কে মা-ছেলে। মা-ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরছে, উভয়েই কাঁদছে আর বলছে, "হায় বিধি তোমার লিখন না যায় খন্ডন।"

#সহিদুল
#গল্প
#সহিদুলের_গল্প
#শিক্ষামূলক_গল্প

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

সহিদুলের লেখা